একটা বাজে গল্প - Romantic Story
- Sagnik Ganguly
- Nov 14, 2024
- 5 min read

কটা বাজে ?
অনেকদিন পর অঘোরে ঘুমোচ্ছিল নীলাদ্রি। ঘুমটা ভাঙতেই মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরোল প্রশ্নটা। নীলাদ্রি জানে, ঘাড় ঘোরালেই দেওয়ালে ঝোলানো গ্রান্ডফাদার ক্লকটা ওর চোখে পড়বে। দাদু বিজয়নারায়ণের খুব ঘড়ির শখ ছিল। ঘড়িটা ওঁর বাবা ওঁকে চাকরি পাওয়ার পর উপহার দিয়েছিলেন। সেই থেকে এখনও সমানে চলছে, থামার যো নেই। অবশ্য, একান্ত নীলাদ্রির মত হাল না হলে কেউ-ই থামতে চায় না।
নীলাদ্রীও চায়নি।
অর্ধোন্মিলিত চোখ দুটো এতক্ষণে অনাবৃত করল নীলাদ্রি। দেওয়ালের প্রপিতামহ ঘড়িটার দিকে নয়, জানালার দিকে। মুহূর্তেই একরাশ মুগ্ধতা আপাদমস্তক গ্রাস করল তাকে।
শেষ কবে বিকেল দেখেছিস নীলাদ্রি?
প্রশ্নটা ভেসে আসতেই হালকা ঈষদুষ্ণ হাসি নীলাদ্রির ঠোঁটের কোণে সচকিত উপস্থিতি জানান দিয়েই মিলিয়ে গেল। এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না। ছিল কী ?
ছোট থেকেই বসন্তের এই সময়টা তার খুব প্রিয়। ছোটবেলায় বাবা বলত, এই সময়টা নাকি রোগের আড়ৎ। মা বলত, দাবানলের মরশুম নাকি এটাই। কিন্ত নীলাদ্রির এগুলোর কোনোটাই ঠিক বোধগম্য হত না। বরং ঋতুচক্রের এই শেষ মরশুমের টাটকা বাতাস, তরুপল্লবে তারুণ্যের সমাহার, প্রাতঃকালে কোকিলকণ্ঠীর তীক্ষ্ণ কলতান মাথার মধ্যে কিলবিলিয়ে উঠত।
শেষ কবছরে প্রবাসের রূক্ষ আবহাওয়া নীলাদ্রির জীবন থেকে বসন্তকে কেমন এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি সে বিচ্ছেদ মেটার অবকাশও ছিল না। তবু, নিয়তি।
নীলাদ্রির ঘরের এই জানালাটা উত্তর-পশ্চিম খোলা। প্রখর গ্রীষ্ম বা প্রবল শীত, বছরের দুই প্রধান মরশুমেই এ ঘরে একপ্রকার টেকা দায় হয়ে পড়ে। শুধু একমাত্র ব্যতিক্রম এই বসন্ত। ফলে সারাবছর প্রবল অনীহায় দূরে সরিয়ে রাখলেও এই একটি মাস নীলাদ্রি এই ঘরটার প্রতি এক প্রবল আকাঙ্খা অনুভব করে। যদিও একটানা এতটা সময় এ ঘরে যে কোনোদিন কাটাতে হতে পারে, তা সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। অবশ্য একাকীত্ব তো তার বরাবরের প্রিয়। আর কারুর থাকুক না থাকুক, অন্তত তার তো কোনো অভিযোগ থাকার কথা নয় ! মনের প্রাণোচ্ছল কোষগুলিতে যবে থেকে প্রাপ্তবয়স্কতা গ্রাস করতে শুরু করেছে, তবে থেকেই তো একাকীত্বের পরিসরে নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে ফেলেছে নীলাদ্রি। মাঝে কটা বছর শুধু সাদা ক্যানভাসে একটু রঙের পোঁচ ধরেছিল আর কি। এখন আবার যে কে সেই, ফ্যাকাশে।
ওদের পাড়াটা এককথায় একটুকরো ভারতবর্ষের প্রতিচ্ছবি। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, ক্রিস্টান, শিখ, কে নেই। ছোটো থেকে এঁদের সাথেই মিলে মিশে বড় হয়েছে নীলাদ্রি। ওর মা ওর এই অবাধ মেলামেশাটা খুব একটা ভালো চোখে না দেখলেও মূল প্রশ্রয় টা দিত দাদুই। দাদু বলত,
"দশজনের সাথে মিশবে, মনের দ্বার রাখবে বাতাসের মত প্রশ্বস্ত। যাতে যেখানেই শূন্যস্থান পাবে, ছুটে চলে যেতে পারো। মনে রাখবে দাদুভাই, সবার থেকেই কিছু না কিছু শেখার আছে। নিরক্ষরতা কোনোদিন প্রকৃত শিক্ষার অন্তরায় হতে পারে না।"
দাদুকে বড্ড মনে পরে নীলাদ্রির। মানুষটার ওকে নিয়ে গর্বের শেষ ছিল না। সবাই বলত, বিজয়বাবুর আদর্শ নাতি।
আদর্শের ভারটা যে বড্ড বেশি, নীলাদ্রি জানে।
বহুবিধ মানুষের কলকলে সকাল থেকে জমজমাট পাড়াটাও এই দুপুরের দিকে এসে কেমন যেন থম মেরে যায়। তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে আস্তে আস্তে জোর করে দম নিয়ে খানিকক্ষণ আগের স্বাভাবিকতায় ফেরার চেষ্টা করে বৈকি, কিন্ত আর সেই পুরোনো ছন্দটা ফিরে পায় না। একচুয়ালি দোষটা পাড়ার নয়। কোনো কিছু একবার হারালে তাকে আবার আগের মত করে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনাটা অনেকটা অঙ্কের 'লিমিট টেন্স টু জিরো'-র মত; পুরোপুরি শূন্য হয়ত নয়। তবুও, প্রায় শূন্যই।
পাড়াটার সাথে নিজের অনেক মিল পায় নীলাদ্রি। একসময় ও নিজেও তো দিনের আলোর মতোই ঝলমলে ছিল। কী থেকে কী যে হয়ে গেল, দুপুর রোদে পাড়াটার মত সেও ঝিমিয়ে পড়ল। যদিও বিকেলের ম্লান আলোয় জোর করে দম নিয়ে উঠে বসার চেষ্টা সে করে। জাস্ট একদিন নয়, প্রতিদিন করে, বারবার করে। তবুও, যা একবার হারিয়েছে তাকে এ জীবনে ফিরে পাওয়ার অবকাশ তার আর নেই।
যা হারিয়েছে !
আচ্ছা, জীবনে ঠিক কী কী হারিয়েছে নীলাদ্রি? আর ঠিক কী কী ই বা পেয়েছে ? মনটা আচমকাই যেন ক্যালকুলাসের খাতা খুলে বসল। আবার খানিকক্ষণ বাদেই হাল ছেড়ে থেমেও গেল। হিসেব তো মিললোই না, উল্টে একটা বেশ মজার জিনিস সে খেয়াল করল। দেখল যে জীবনে হারানোর হিসেব প্রাপ্তির হিসেবের থেকে অনেকটাই সহজ। কী কী হারিয়েছে ভাবতে বসলেই গড়গড় করে সমস্ত বিষণ্ণতা ভরা হা-হুতাশ গুলো মাথায় কিলবিল করতে শুরু করে। যেন ওরা বেরোনোর জন্য তৈরী হয়েই ছিল, নীলাদ্রির মনের আভাস পেতেই দৌড় লাগল। ওদিকে প্রাপ্তির লিস্টটা কতক ফাঁকাই পরে আছে। খুব বড় কোনো এচিভমেন্ট ছাড়া আর কিছুই শালা মাথায় আসছে না। যেন জীবন থেকে ছোটখাটো খুশির মুহূর্তগুলো একরকম হারিয়েই গেছে !
হারিয়েই গেছে ! চমকে উঠল নীলাদ্রি। খুশির মাঝেও হারানোর চিন্তা আসছে !
গুম হয়ে দু চোখ বুঁজে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। ছোটবেলায় ওকে এরম চোখ বুঁজে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলে বন্ধুরা পেছনে লাগত, পাগল বলত। কিন্ত নীলাদ্রি কাউকে কোনোদিনই এটা বোঝাতে পারেনি যে খোলা চোখের দৃষ্টিবদ্ধতা দু চোখের পাতা এক করলেই অনেকটা কেটে যায়। কারণ তখন আর মানুষ করোটির খোলসে বসানো দুটো লেন্স দিয়ে দেখে না, দেখে মনের চোখ দিয়ে। ফলে সাধারণভাবে যেখানে মানুষের দৃষ্টি আটকে যায় ওপরের ওই বিদঘুটে বোরিং সিলিংয়ে, বন্ধ চোখে নীলাদ্রি ওই সিলিং ফুঁড়ে আকাশ পেরিয়ে ছুঁয়ে আসে মহাকাশ, এক বুক তৃপ্তি নিয়ে।
তৃপ্তিটা অধরাই থেকে গেল জানালার বাইরে গলিটা থেকে মেয়েলি গলায় খিলখিল করে ভেসে আসা হাসির শব্দে, সাথে সাথেই হুড়মুড় করে কানে প্রবেশ করল পুরুষালি স্বরের শব্দস্রোতও। বেশ কষ্ট করেই মাথাটা একবার তুলল নীলাদ্রি। দুটি অল্প-বয়সী ছেলে-মেয়ে। নীলাদ্রির থেকে ছোটোই হবে, বোধহয় কলেজ স্টুডেন্ট। সাইকেল নিয়ে হেঁটে যেতে যেতে খুনসুটিতে মত্ত।
বিভোর হয়ে তাকিয়ে রইল নীলাদ্রি। খানিকক্ষণের বেমালুম উবে যাওয়া ঘাড়ের যন্ত্রণাটা ওরা দৃষ্টির আড়ালে যেতেই আবার চাগাড় দিয়ে উঠল, রীতিমত জোরেই। নীলাদ্রির মুখ থেকে অস্ফুটে একটা উঃ ছিটকে বেরিয়ে সামনের দেওয়ালটায় কুৎসিত ভাবে ছড়িয়ে পড়ল। তবে দাগটা শুধু ও বাদে আর কেউ দেখতে পেল না। অবশ্য গত মাসের সেই দাগটাও তো ও বাদে আর কেউ দেখতে পায় না, পায় কী ? তাছাড়া দেখতে পেয়েও বা লাভ কী, মোছার উপায় তো আর নেই। যখন ছিল, তখন সামান্য সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে আসা যখন ওর পক্ষে সম্ভব হয়নি, তখন আজ শুধুশুধু সব শেষ হয়ে যাওয়ার পরে কী হলে কী হত তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কি লাভ আছে?
হেসে ফেলে নীলাদ্রি। মস্তিষ্কের কোষে হঠাৎই গত জানুয়ারির সেই সন্ধ্যের কথাগুলো ভেসে ওঠে। সেই যে, ওর আঙ্গুলগুলো আঁকড়ে ধরে ধৃতি বলেছিল,
"এবারটা হয়ত বড্ড দেরি করে ফেললি। কিন্ত পরেরবার আর কটা মাস আগে বলিস, যাতে অন্তত আমাদের দুজনের মাঝে আর অন্য কারোর জীবন না জড়িয়ে পরে।"
আশ্চর্য শক্তি মেয়েটার। সেদিন যতক্ষণ ওর সামনে দাঁড়িয়েছিল, এমনকি শেষবার যাওয়ার আগে শক্ত করে আঁকড়ে ধরার সময়ও একটা ফোঁটা চোখের জল বেরোতে দেখল না নীলাদ্রি। মেয়েরা যে আসলে কী ধাতু দিয়ে তৈরী তা বোধহয় কোনো বিজ্ঞানীই কখনও বার করে উঠতে পারবেন না। তবে সে নিজে যে একটি আপাদমস্তক মূর্খ তাতে তার কোনোরকম সন্দেহ নেই।
ধৃতি তার হৃদমাঝারে প্রবেশের ধৃষ্টতা দেখিয়েছে আজ বহুদিন। সেই কবে কলেজে পরিচয় ওদের। বন্ধুত্বটা গভীর হতে খুব বেশি সময় নেয়নি। অথচ অদ্ভুত ভাবে প্রথম কবছরে ধৃতিকে খুব কাছের একজন বন্ধুর থেকে বেশি কিছু ভাবতেই পারেনি নীলাদ্রি। বা বলা ভালো, ভাবার চেষ্টাও করেনি। কিন্ত সেবারে গরমের ছুটিতে বন্ধুদের সাথে ট্যুরটায় গিয়েই সব হিসেব গন্ডগোল হয়ে গেল। ভালোবেসে ফেলল নীলাদ্রি। তাও কাকে? না ধৃতি কে। আর প্রিয় বন্ধুকে ভালোবেসে ফেললে ঠিক যে ভয়টা অন্য সবাইকে জাপ্টে ধরে,ওর ও ঠিক তাই হল। প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে বন্ধুবিচ্ছেদের ভয়ে সংক্রামিত নীলাদ্রির ধৃতিকে আর 'ভালোবাসি' বলে ওঠা হল না।
দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর পর যখন ধৃতি ও সে, দুজনেই আলাদা ভাবে প্রতিষ্ঠিত, তখন গতবছরের শেষের দিকে একদিন নীলাদ্রির কাছে ধৃতির ফোন এল। সামনের মাঘে ধৃতির বিয়ে, আর নীলাদ্রিকে সেখানে থাকতেই হবে।
তখন অবশেষে নীলাদ্রির হুঁশ ফিরল, এতদিনের সব হিসেবে-নিকেশ গুবলেট হয়ে আগল খুলে সদ্যজাত তটিনীর মত হুড়মুড় করে আবেগের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। কিন্ত ততদিনে সময় গিরিখাত যে শুকিয়ে গেছে। ফলে যা হবার তাই হল। ধৃতির জীবনটা অপূর্ণ আর নীলাদ্রির শরীরটা অসুস্থ হয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার এ আক্রান্ত নীলাদ্রি একপ্রকার শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। তার ওপর করোনার প্রভাবে ওয়ার্ক-ফর্ম-হোম এসে পড়ায় জীবনটা যেন আরও দুর্বিসহ হয়ে উঠল।
প্রথম কটা মাস বাড়িতে থেকে আরও দমবন্ধ লাগতে শুরু করল নীলাদ্রির। কারণ বাড়িতে সবার অলক্ষ্যে গুমোট করা কষ্টটা তো আর প্রকাশ করা যায় না ! তাই একরকম জোর করেই কাজের অসুবিধার অজুহাতে শহরের বাইরে নিজেদের পুরোনো বাড়িতে এসে ঠাঁই নিল সে। সপ্তাহের প্রথম পাঁচটা দিন যন্ত্রের মত সকাল থেকে রাত অবধি ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে থেকে দিন শেষে রান্নার লোকের বানিয়ে দেওয়া বিস্বাদ তরকারি দিয়ে মুড়ি মেখে খেয়ে শুয়ে পড়া, আর বাকি দুটো দিন বিছানায় শুয়ে থেকে অসুস্থ রুগীর মত আধো ঘুম-আধো জাগরণে ক্ষণে-ক্ষণে এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দেওয়াটাই এখন তার জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নীলাদ্রি জানে, এভাবে জীবনযাপন চালিয়ে গেলে খুব বেশিদিন আর এ জীবন যাপনের সুযোগ সে পাবে না। কিন্ত সে এ ও জানে, প্রাণ খুলে আনন্দ করে বাঁচার স্বার্থকতা তার আর নেই। এখন যা বাকি আছে, তা নিছকই কর্তব্য, আর অপূর্ণ স্বপ্নের ভারবাহী দীর্ঘশ্বাস।
অপূর্ণ স্বপ্নের ভারেই হোক কিংবা, অবসন্ন শরীরের ক্লান্তিতেই হোক, আস্তে আস্তে আবারও একবার পাশ ফিরল নীলাদ্রি। মাঝে মাঝেই গভীর রাতে ঘুম ভেঙে উঠে হঠাৎই ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। সেই কান্না কিন্ত কখনই শুধুমাত্র দুঃখের নয়, বরং অনেকটা আফশোসের, অনেকটাই হতাশার।
যদি একটিবার সাহস করে ধৃতিকে বলত ! ধৃতি ওকে আর যাই হোক, ভুল অন্তত বুঝত না। যদি একটিবার...
মাথার যন্ত্রনাটা তীব্র হচ্ছে ক্রমশ।
চোখটা বন্ধ করল নীলাদ্রি। চোখে-মুখে শেষ বিকেলের মলিন আলো আঁকি-বুঁকি কাটছে। গভীর ঘুমে ঢলে পড়ার আগের মুহূর্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার ভেতর থেকে। আর কেউ জাপ্টে ধরার আগেই সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়েও গেল সহসা।
কিছু মানুষের জীবনটাই ট্র্যাজেডির সুতোয় বাঁধা থাকে।
নীলাদ্রিও বোধহয় সেই দলেই।
Romantic Story
Comments