উপলব্ধি - Love Stories
- Sagnik Ganguly
- Nov 1, 2024
- 3 min read
রেলব্রিজটার মুখের বাঁকটা ছাড়িয়ে ট্রেনের শেষ বগিটাও অদৃশ্য হলে পবন হাঁটা শুরু করল। মহিমা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বেশ গুছিয়ে বসেছে। গোছাতে তো হবেই। তা সে ঘর-ই হোক, কি জীবন। কিন্তু পবন গোছাতে পারল কই! ওর প্রাণের বন্ধু বিপিন যদিও বা বলে এখনও সময় ঢের, পবন জানে আসল সত্যিটা তা নয়। সময়ের কাজ সময়ে না সারলে হয় কাজ ফুরোয়, কিংবা সময়। পবনের দুই-ই ফুরিয়েছে।
- কিন্তু আমি চেষ্টা তো করেছিলাম!
বৃষ্টিভেজা প্ল্যাটফর্মের একচিলতে আকাশের দিকে চেয়ে নিষ্ফল অভিমানে আর্তনাদ করে পবন। কিন্তু যাঁর উদ্দেশ্যে বলা, তাঁর থেকে কোনো উত্তর ভেসে আসে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, তবে কি সত্যিই কিছু নেই? সেই কবে থেকে যাকে নিয়ে মনের মনিকোঠায় যত্নে এঁকেছে সমস্ত চিত্রপট, সে নিজেই যখন কোনোদিন কিছু বুঝতে পারল না, তবে আর বিশ্বাসের ভিত্তি কোথায়? কোথায় আর 'সারাজীবন ভালোবাসব' বলার সাহস? কোথায়ই বা থাকতে চাওয়ার অঙ্গীকার?
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ধপ্ করে পবনের বুকের ভেতর থেকে হুড়মুড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। মহিমা এখন আরও খানিকটা দূরে চলে গেছে। মহিমার চলে যাওয়াটার থেকেও বুঝতে না পারার ক্ষতটাই ওকে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। অনেক আশা নিয়ে পবন আজ এসেছিল। ভেবেছিল, এতদিনে না হোক, অন্তত আজ, চলে যাওয়ার ঠিক আগে ওদের সম্পর্কের সুতোটা বেঁধে নেবে। কিন্তু তা আর হল কই। মহিমা আজও বুঝল না।
- তুমি কি বুঝিয়েছ, যে ও বুঝবে?
চমকে ওঠে পবন। নিজের ভেতরেই সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষ যে এতদিন ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে তা এর আগে কখনও টের পায়নি। গলায় যতটা সম্ভব জোর এনে বলল,
- হ্যাঁ বুঝিয়েছি তো।
- কি বুঝিয়েছ?
- এই যে ওকে আমি ভালোবাসি!
পবন টের পেল যে একটু আগে আনা গলার জোরটা এখন অনেকটাই মিইয়ে গেছে। হয়ত ওর ভেতরের মানুষটাও সেটা বুঝতে পারল। তাই বোধহয় মৃদু শ্লেষের সাথে বলে উঠল,
- মুখ ফুটে বললেই না একবারও, আর নাকি বুঝিয়েছ!
- বুঝতে গেলে বলার প্রয়োজন আছে নাকি? ইচ্ছে থাকলে ঠিকই বোঝা যায়।
- আর বুঝতে পারছে না মানেই ইচ্ছে নেই? বাহ্ প্রেমিক বাহ্।
পবন এতক্ষণে খানিক হকচকিয়ে গেছে। এসব কেউ শুনলে নির্ঘাত পাগল বলবে। নিজের সাথে নিজের দোটানা; এ আবার হয় নাকি? তখনই আবার, মনের কোনো এক গভীর প্রান্তর থেকে ভেসে এল,
- প্রেমিক, হাতের প্রতিটা আঙ্গুল যখন সময় নয়, মানুষ কেমনে হয়? কেউ যদি ঈশারা বুঝতে না পারে, তবে তাকে ইশারা করা কেন? সরাসরি জানাও তাকে তোমার মনের কথা। আসলে জানো তো, আমরা সহজ জিনিস সহজ ভাবে দেখতে জানি না, বুঝতে জানি না। আজ যাকে তুমি অবুঝ ভাবছ, হয়ত সেও তোমার মতই তোমার একটিবার মুখ ফুটে বলার অপেক্ষায়। হয়ত সেও আজ তোমার মত একই প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিল। হয়ত সেও তোমার মতই ভগ্ন হৃদয়ে দূর হতে আরও দূরে সরে যাচ্ছে।
এক্ষণে পবনের হুঁশ ফিরল। সত্যিই তো এভাবে ভেবে দেখেনি। চিরকাল একপক্ষেই হিসেব-নিকেশ করে গেছে পবন। তাই জন্যই বোধহয় একই অঙ্ক বারবার করে ভুল হয়। আকুল হয়ে সেই অচেনা ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করল,
- তবে এখন উপায়? আমি যে বড্ড দেরী করে ফেললাম।
- জীবনে দেরি বলে কিছু হয় না প্রেমিক। এটাই নিয়তি, এটাই সঠিক সময়। মহিমা এখনও খুব দূরে যায়নি। ওকে জানাও তোমার মনের কথা। যাও পবন, যাও।
চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলটা মুছে দ্রুত হাতে ফোনটা বার করে নম্বরটা ডায়াল করল পবন। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ফোনের ওপারে সেই অতিপরিচিত কন্ঠস্বরটা ভেসে আসতেই মনের সব জোর একত্র করে পবন বলে উঠল,
- হ্যালো...মহিমা...সরি। হয়ত খানিকটা দেরি করে ফেললাম। তবু, এবার না বললে আর হয়ত বলাই হবে না। মহিমা, আমি তোমায় ভালোবাসি। আজ থেকে নয়, অনেকদিন ধরেই বাসি। কোনোদিন সাহস করে মুখ ফুটে বলতে পারিনি। ভেবেছি তুমি রাগ করবে, কিংবা দূরে সরে যাবে। কিন্তু এবার যখন না বলেও সেই দূরে সরেই যাচ্ছ, তখন আর লুকোচুরির প্রবৃত্তি নেই। আমায় ক্ষমা কোরো। এতদিন না বলার জন্য, এবং আরও বেশি করে আজ হঠাৎ এভাবে বলার জন্য।
ফোনের ওপার থেকে প্রথমে খানিকক্ষণ কোনো কথা ভেসে এল না। পবন ভাবল মহিমা বোধহয় সত্যিই ওর ওপর রাগ করেছে। এতটাই যে কি বলে ভৎর্সনা করবে বুঝে উঠতে পারছে না। নিজেই আবারও ক্ষমা চাইতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই, খিলখিল হাসির শব্দে পবনের সমস্ত চিন্তাভাবনা একেবারে গুলিয়ে গেল। মহিমা হাসছে। কিন্তু কেন? উত্তরটা পেল একটু বাদেই,
- এই এইটুকু একটা স্বীকারোক্তিতে পাঁচ বছর লেগে গেল? সত্যি, পারো বটে। তুমি কেবল নামেই পবন, সাহসে নিতান্তই হনুমান। কিন্তু উপায় নেই, এই হনুমানকেই যে আমি নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসি। সেই কবে থেকে অপেক্ষায় ছিলাম আজকের দিনটার। শেষমেষ বললেন মহাশয়...শেষের কথাটা বলতে গিয়ে মহিমার গলাটা খানিক ধরে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
- এই যে বলে ফেললে। এবার অপেক্ষার কষ্টটা আরও বেড়ে গেল। তবে হ্যাঁ, এবার আর কোনো চিন্তা নেই। নিশ্চিন্ত থেকো। তোমার মহিমা তোমায় ছেড়ে কোত্থাও যাবে না। স্থানের দুরত্ব থাকলেও মনের দূরত্ব কখনও আসবে না। ভালোবাসি।
পবনের মনে হল এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ওর চেয়ে বেশি সুখী বোধহয় আর কেউ নেই। ওর দু-চোখে এখন একরাশ স্বপ্ন, আর সেই স্বপ্নজালে জ্বলজ্বল করছে ভবিষ্যতের দেওয়াললিখন,
"দীর্ঘকাল ভালোবেসে দেখিলাম
মন্দ কিছু নয়, বাসিলে বাসাই যায়"
****
শেষের দুটি লাইন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা।
Love Stories

תגובות