একটা অসমাপ্ত গল্প (An Unfinished Story) - Eternal Love
- Sagnik Ganguly
- Nov 5, 2024
- 4 min read

"কটা বাজে?"
বালিশে ঠেস দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করছিল রূপা। খানিক তন্দ্রা মতন এসেছিল ইন্দ্রর। আগে হলে বাড়িতে ডাকাত পড়লেও যার ঘুম ভাঙত না, গত কয়েক মাসে অন্য আরও অনেক কিছুর সাথে সাথে সেটাও পাল্টে গেছে। ধড়ফড় করে উঠেই রূপার দুটো হাত শক্ত করে ধরল ইন্দ্র,
"তোকে বলেছি না, কষ্ট করে উঠে বসবার কোনো দরকার নেই। ইচ্ছে হলে আমায় ডাকবি।"
"তোর ভরসাতেই তো জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। এখন এই শেষ বেলায় এসে নিজের জন্য একটু বাঁচতে দিবি না, ইন্দ্র?", ঠোঁটের কোণে জোর করে হাসিটা ফোটানোর চেষ্টা করল রূপা।
"দেখ রূপা, তুই এখনও মরিস নি। আর যদ্দূর আমি জানি, এখনও তোর ব্রেণ তার কার্য্যক্ষমতা হারায়নি, এখনও তোর হার্ট ঠিকঠাক রক্ত সঞ্চালন করছে, এখনও তোর দুটো ফুসফুস পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন-কার্বণ ডাই অক্সাইড আদানপ্রদান করছে। অর্থাৎ একজন সুস্থ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা যা অবলম্বন প্রয়োজন, তার সব কিছুই ইউ পজিটিভ্লি হ্যাভ। দেন কেন বারবার এরকম ভাবছিস? মরার আগেই কেন এভাবে মরে যাচ্ছিস?", নাইটল্যাম্পের আবছা আলোয় বিহ্বল দেখায় ইন্দ্রর চোখ দুটো।
হেসে উঠল রূপা। অনেকদিন পর তার এরকম এক গাল প্রাণখোলা হাসি দেখল ইন্দ্র। ওর মনে হল, অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটা যেন এক নিমেষেই হাজার ওয়াটের আলোর ঔজ্জ্বল্যে ভরে গেল। হাসতে হাসতেই নিজের একটা হাত ইন্দ্রর হাতের ওপর রাখল রূপা। শীতের রাতে ইন্দ্রর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া হাতটাও মুহূর্তের মধ্যে এক অন্যরকম উষ্ণতায় ভরে উঠল। হাসিটা থামলে এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রূপা বলল,
"আচ্ছা ইন্দ্র, একসময় আমি মরার কথা বললেই তো ভীষণ খাপ্পা হয়ে উঠতিস। আজকাল হঠাৎ এরম শান্ত হয়ে বোঝাচ্ছিস, ব্যাপারটা কী?"
কী একটা বলার জন্য ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়েই আবার বন্ধ হয়ে গেল ইন্দ্রর। না, রাগ, অভিমান, দুঃখ, কষ্ট গুলো আপাতত পরের জন্যই তোলা থাক। রূপার সামনে ভেঙে পড়লে চলবে না, কোনোভাবেই না।
ভাবতে ভাবতেই উদাস হয়ে গেছিল সে। নাইটল্যাম্পের আবছা আলোয় কেমন একটা ঘোর লেগে গেছিল তার। রূপার কথায় হুঁশ ফিরল,
"কিরে, বললি না, কী ব্যাপার?"
মৃদু হাসলো ইন্দ্র,
"আরে আজকাল আর রাগ-টাগ তেমন হয়-ই না, কর্পূরের মত সব যেন উবে গেছে।"
"তাই নাকি?", ভুঁরু কুঁচকে বলল রূপা, "তা ছেলের হঠাৎ ভবগুরে ভবগুরে ভাব জন্মানোর কারণ কী?"
"ভবগুরে আর কোথায় হতে পারলাম রে, এ জীবনটা তো একটা পাগলীর সাথেই আটকে গেলাম।"
"আরে সে তো এতদিন। এরপর তো তোর একদম ছুটি, তারপর? মশাইয়ের প্ল্যান-ট্যান একটু শুনি-ই না।"
নাইটল্যাম্পের মৃদু আলোয় ভাগ্গিস সবটা দেখা যায়না! নয়ত রূপা দেখতে পেত, ইন্দ্রর চোখের কোণ থেকে কয়েক ফোঁটা জল টলমল করতে করতে দু-গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। ছিটকে আসা কান্নার দমক কোনোমতে চেপে রেখে জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে ইন্দ্র বলল,
"হ্যাঁ করেছি বৈকি। কত্ত কত্ত দারুন দারুন প্ল্যান। কিন্ত তোকে বলব না।"
"কেন? আমায় বললে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে শুনি!"
"নাহ। এই যে তুই খালি পালাই পালাই করছিস, তাই বলব না।"
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকল রূপা, কোনো কথা বলল না। তারপর হঠাৎই জোর করে উঠে বসার চেষ্টা করতে গেল। অমনি ইন্দ্র লাফ মেরে উঠে ওকে দু হাতে শক্ত করে ধরে মুখের ওপর ঝুঁকে বলে উঠল,
"আরে আরে করছিস কী, নিজে নিজে উঠতে পারবি না সেটা তো তুই জানিস। একটু আগেও তো বললাম যে আমাকে বলতে, উফ!"
ইন্দ্র ওকে আস্তে আস্তে ধরে ধরে বসিয়ে দিতেই কাঁপা কাঁপা হাত দুটো তুলে ইন্দ্রর গালে রাখল রূপা। তারপর মৃদু হেসে বলল,
"বলে দিলে কী আর আমার পাগলটার চোখের জলের হুদিস পেতাম!"
খানিকক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইন্দ্র, কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছিল না সে। তারপর শেষমেশ আর থাকতে না পেরে রূপার হাতে হাত রেখে ওর বিছানার ডানপাশের একচিলতে ফাঁকা অংশটায় আলতো করে বসে প্রাণপনে জড়িয়ে ধরল ওকে, নিঃশব্দে।
একটা প্রায়-অন্ধকার ঘরে দুটো প্রাণী নিশ্চল, নীরব, মহীরুহের ন্যায় একে-অপরকে আঁকড়ে ধরেছে। পাঠক, বিশ্বাস করুন, আজ আপনি বা আমি যদি ওই ছোট্ট খুপরির এক কোণায় বসে নিঃশব্দে ওদের পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করতাম, তবুও না কেউ ওদের দেখতে পেতাম, না কেউ শুনতে পেতাম। শুধু, দীর্ঘক্ষণ ব্যর্থ চেষ্টা শেষে শেষমেশ যখন হাল ছাড়ার উপক্রম করতাম, তখন অনুভব করতাম দুটি শরীরের অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে আসা এক ঝলক টাটকা বাতাস। অনেক উঁচু পাহাড়ের বুকে প্রথমদিন বেড়াতে গিয়ে এক বুক নিঃশাস নিলে ধুলো-বালির কলুষতাহীন টাটকা হাওয়া আমাদের ফুসফুসদ্বয়কে যেরকম প্রস্বস্তি দেয়, সেই রাতে সেই আধো ঘুম-আধো জাগরণে ছটফট করতে থাকা শহরের বুকে ঘড়ির কাঁটার সাথে অহর্নিশি প্রতিযোগিতায় মেতে থাকা আপনারও ঠিক সেরকমই অনুভব হত। এর কারণটা কিন্ত আপনার মস্তিষ্কের বিকার নয়, কিংবা ব্যর্থতার ফলস্বরূপ স্নায়ুতন্ত্রে এড্রিনালিনের ক্ষরণও নয়। কারণটা নিছকই দুটো মানুষের নিষ্কাম-নিষ্কন্টক ভালোবাসা, ব্যাস।
****
ইন্দ্রর বুকে মাথা গুঁজে একরকম ঘুমিয়েই পড়েছিল রূপা। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা স্বপ্নও দেখছিল। অনেক বছর আগের একটা দৃশ্য।
তখন সবে সবে আলাপ হয়েছে ওদের। মানে প্রেমটা ঠিক তখনও ডানা বাঁধেনি, বন্ধুত্বের পাশাপাশি ভালো লাগার এক আদুরে উষ্ণতায় ছটফট করছে দুজনে।
তখন বর্ষাকাল। সকাল থেকে স্বাভাবিক ভাবেই আকাশের মুখ ভার। মাঝে-সাঝেই দু-এক পশলা মুষলধারায় নেমে খানিক বাদেই সচকিতে রোদের বুকে আত্মসমর্পণ করছে।
ওদের দেখা করার কথা ছিল সেদিন। এমনিতে এক কলেজে পড়ার সূত্রে দেখা-সাক্ষাৎটা নিয়মিত হতেই থাকত। কিন্ত কলেজ ও কাজের দড়ি-টানাটানির বাইরে এটাই ছিল, যাকে বলে ওদের 'ফার্স্ট ডেট।'
তা সেই মত সরোবরের ধারে গাছের তলায় একটা বেঞ্চিতে সংক্ষিপ্ত ব্যবধানের পরিপ্রেক্ষিতে দুজনে যখন বসল, তখন ঘড়ি বলছে দুপুর তিনটে। গোটা সরোবরে এক-আধটা ঝোপঝাড় বাদে আর কোথাও নিদেনপক্ষে জন-মানবের কোনো দেখা নেই। তার ওপর প্রথম 'এপো'; লজ্জা-ভয়-সঙ্কোচের পাশাপাশি এক তীব্র আনন্দের রেশ খেলা করছিল দুজনের চোখে-মুখে। সব-ই ছিল, শুধু মুখ ফুটে বলার মত কোনো কথা কেউ খুঁজে পাচ্ছিল না।
এরম করেই বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল। বৃষ্টির টুপটাপ, কপোত-কপোতীর কলতান, মেঘের গুরুগুরু, ঝোড়ো হাওয়া সব কিছুই যখন ওদের নীরবতা ভঙ্গ করতে ব্যর্থ হয়েছে, ঠিক তখনই, মৃদু গলায় গুনগুন করে উঠল ইন্দ্র,
"Abhi Na Jao Chhod Kar-
Ke Dil Abhi Bhara Nehi.
Abhi Na Jao..."
মুহূর্তের মধ্যে হাতটা ধরে থামতে বলেছিল রূপা। খুব অবাক হয়ে গেছিল ইন্দ্র, খুব। এরকম তো কেউ কখনও বলেনি! ও তো এতটাও খারাপ গায় না। ভীষণ আহত হয়েছিল। কিন্ত কিছু বলেনি, চুপ করে গেছিল একদম। খানিক বাদে ইন্দ্রর কাঁধে মাথা রেখেছিল রূপা। মাথা রেখে বলেছিল,
"আমি তোকে হার্ট করে থাকলে আই এম সরি। আসলে আজ যদি তুই আমায় সুন্দর সুন্দর গান গেয়ে শোনাস, আর এরপর কখনও আমায় ছেড়ে চলে যাস, এই গান গুলো চিরকালের মত অভিশপ্ত হয়ে যাবে আমার কাছে। আমি আর কোনোদিনও এই গান গুলো শুনতে পারব না। তাই..."
বিষ্ময়ে হতবাক ইন্দ্র কোনো উত্তর দেয়নি, বা বলা ভালো দেওয়ার মত কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি। কিন্ত মনে মনে রূপার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানিয়েছিল। আর সাথে সাথেই পাশের ওই মানুষটাকে কোনোদিন ছেড়ে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল, নীরবে। কিন্ত বছর দেড়েক আগে...
****
এলার্মের শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল রূপার। কটা বাজে? আন্দাজে বুঝল সাড়ে পাঁচটা। কদিন থেকেই শরীরটা খারাপ। দুদিন তো জ্বরের জন্য উঠতেই পারেনি। আজ তাও বা একটু বেটার। আগে অবশ্য এরকম ঘন ঘন শরীর খারাপ হত না রূপার। ইন্দ্র থাকতে অনিয়মের কোনো জো ছিল নাকি! বছর দেড়েক আগে ব্রেণ ক্যান্সার ধরা পরে ইন্দ্রর। সেই সময়টা মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল ওদের। অনেক চেষ্টা করেছিল রূপা ইন্দ্রকে বাঁচানোর। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অক্লান্ত ভাবে সেবা করে গেছে। কিন্ত শেষমেশ ধরে রাখতে পারেনি। তার পর থেকেই সব কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে গেছে, আর গুছিয়ে নিতে পারেনি।
আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে বসল রূপা। এলার্মটা তখনও বাজছে। রোজ-ই বাজে। যতদিন রূপা বাঁচবে, ততদিন-ই বাজবে। কারণ রূপা জানে, এই এলার্মটাই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে-
"Bura na Maano Baat Ka,
Ye Pyar Hai Gila Nahi..."
ক্লান্ত হাতে এলার্মটা বন্ধ করল রূপা। স্থির চোখে সকালের সদ্দ উজ্জীবিত সূর্যের আলো এসে পড়েছে। গত রাতের স্বপ্নটা এখনও দিনের আলোর মতই টাটকা হয়ে ভাসছে রূপার চোখে।
ইন্দ্র কথা রেখেছে।
রূপা জানে।
ইন্দ্র, কথা রেখেছে।
--------*--------
Comentários