ছেলেমানুষ - Romantic Story
- Sagnik Ganguly
- Nov 3, 2024
- 4 min read

হোয়্যাটস্যাপ-এ কী একটা জরুরী ফোন নম্বর খুঁজতে গিয়ে হঠাৎই নামটা চোখে পড়ল অনীশের। আর সাথে সাথেই কদিন আগে ভেবেও পরবর্তীতে কাজের চাপে ভুলে যাওয়া কথাটা ওর আবার মনে পড়ল, পেখম তো রিপ্লাইটা এখনও দিল না!
চ্যাটটা খুলল অনীশ। এবং আরও অবাক হল। মেসেজটা ডেলিভারি অবধি হয়নি! মানে পেখম, কোনো অজ্ঞাত কারণে গত দুসপ্তাহব্যাপী সময়ে একবারের জন্য ফোনের নেটটাও অন করেনি!
নেট অন করেনি, নাকি হোয়্যাটস্যাপ টাই উড়িয়ে দিল! ভাবল অনীশ। কোনো বিপদ্-আপদ্...ধুর, এতদিনে একটা ফোন অন্তত করা উচিত ছিল অনীশের। আর কিছু না হোক, অন্তত বন্ধুত্বের স্বার্থে তো বটেই।
মিনিট খানেক চোখ বুঁজে বসে রইল অনীশ, চুপচাপ। হ্যাঁ ও না এর চক্রব্যূহে গোলগোল ঘুরতে ঘুরতে নিজের অজান্তেই কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মানুষটার নম্বরটা ডায়াল করা অনীশের হুঁশ ফিরল সেই একদা অতি-পরিচিত কন্ঠস্বরে,
"হ্যালো!"
"হ্যা...হ্যা...হ্যালো!", গলাটা সামান্য কেঁপে গেল অনীশের।
"হ্যাঁ বল", শান্ত গলায় উত্তর দিল পেখম।
একবার ঢোঁক গিলল অনীশ। সত্যি সত্যিই ফোনটা করে ফেলবে জানলে আগে থেকে স্ক্রিপ্টটা অন্তত রেডি করে বসত। কয়েক মুহুর্ত ইতস্তত করে তারপর বলল,
"না মানে সেরকম কিছু না। তোকে দু-সপ্তাহ আগে দুটো ম্যাসেজ করেছিলাম। আজ দেখলাম একটাও ডেলিভার্ড হয়নি। তাই একবার তোর খোঁজ নিতেই আরকি..."
খানিকক্ষণ সব চুপ। জানালার বাইরে থেকে কোন এক রাতচরা পাখি হঠাৎই তার অস্তিত্বের জানান দিয়ে খুব কাছ দিয়ে উড়ে গেল। পরক্ষণেই এক ঝলক দমকা ঠান্ডা বাতাস অনীশের সর্বাঙ্গে শীতল পরশ বুলিয়ে দিল।
ঘড়িটা দেখল অনীশ। রাত ১টা। ছোট থেকেই একাকীত্ব প্রেমী অনীশেরও এতটা নৈঃশব্দ্য হঠাৎই কেমন যেন অসহ্য লাগতে লাগল।
হল টা কী পেখমের? বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল নাকি!
"পেখম...!"
কোনো সাড়া এল না।
ধুর, বিরক্ত হয়ে অনীশ ফোনটা কাটতেই যাচ্ছিল। ঠিক তখনই ওপাশ থেকে উত্তর এল,
"সরি। মা ওষুধ খেতে ভুলে গেছিল, সেটাই দিয়ে এলাম। বল, কী বলছিলি।"
"ওহো। না সেরকম কিছু না। তোকে কদিন আগে হোয়াটসঅ্যাপ-এ টেক্সট করেছিলাম। মেসেজটা ডেলিভার..."
"ওহো। আরে আমি হোয়াটসঅ্যাপটা উড়িয়ে দিয়েছি", হাসতে হাসতেই বলল পেখম।
"উড়িয়ে দিয়েছিস, কিন্তু কেন?"
"আরে আর বলিস না। এতদিন করোনার অজুহাতে দেদার ফাঁকি দিয়েছি। কলেজে ক্লাস-ফাসও সেভাবে করিনি। সেদিন পরীক্ষাটা ক্যানসেল হয়ে গেছে শুনে বেজায় মজা পেতে গিয়েও হঠাৎই মনে হল, আজ যদি অফলাইনে পরীক্ষাটা হত, তবে একচুয়ালী কটা সাপ্লি খেতাম! ব্যাস, মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। তারপর থেকেই জীবনে প্রথমবার এতটা সিরিয়াস হয়ে পড়াশোনা শুরু করেছি। আর বুঝতেই পারছিস, ডিসট্র্যাকশনটা আটকাতে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ছুটি নেওয়াটার প্রয়োজন ছিলই। সো..."
"আচ্ছা", একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনীশ। তারপর বলল, "বাই দা ওয়ে, আছিস কেমন?"
"ভালোই। স্নান-খাওয়া-ঘুম বাদে বাকি সময়টা পড়ছি। বোরিং, রুটিন লাইফ। তুই?"
"আছি ভালোই। অফিসের কাজ নিয়ে গোটা সপ্তাহটাই প্রবল ব্যস্ততায় কাটে। এই উইকেন্ডের সময়টাতেই যা একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।"
"বেশ বেশ। শরীর ঠিক আছে তো?"
"হ্যাঁ আমি ঠিকই আছি। মা মাঝে পজিটিভ হয়েছিল, এখন পুরোপুরি সুস্থ।"
"বেশ বেশ।"
এরপর দুজনেই একরকম চুপ করে গেল, কী বলবে সেটা কেউই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। আসলে খুব বেশিদিন বাদে কারুর সাথে কথা হলে প্রত্যাশা থাকে যে এতদিনের সব জমে থাকা ঘটনাপ্রবাহ বাক্স উপুড় করে দুজন দুজনের কাছে তুলে ধরবে। কিন্তু দীর্ঘ বিরহে সম্পর্কের বুনিয়াদটাই যদি আলগা হয়ে পড়ে তবে মুখবিবরের আগল খোলার পরিবর্তে কেমন যেন বাঁধা পড়ে যায়। ওদের ব্যাপারটাও তেমনই। একটা সময় ছিল যখন অনীশের দিবানিদ্রা থেকে পেখমের ঘুম ভাঙানো টাটকা ভোরের স্বপ্ন, সবটাই ছিল একে-অপরের নখদর্পণে। একজনের সারাটাদিন কেমন গেছে তা অপরজনকে না জানানো অবধি সেই মানুষটার রাতে ঘুমই আসত না। সেই সময় রিষড়া শহরের অলিগলিতে কান পাতলেই হয়ত আপনার কানে ভেসে আসত পেখম ও অনীশের সম্পর্কের চাপা গুঞ্জন। অথচ বিশ্বাস করুন, ওদের সম্পর্কটা কিন্তু নিছকই গভীর বন্ধুত্বের। তাতে প্রেম হয়ত ছিল, ভালোবাসাও প্রবলভাবে ছিল, কিন্তু তা বলে তাদের প্রেমিক-প্রেমিকার শিরোপায় ভূষিত করাটা নিতান্তই বালখিল্যতার পরিচয়। তাছাড়া জানেনই তো, আমাদের সমাজে দুটি পুরুষ ও নারীকে কেবলই বন্ধু মনে করতে আমরা খুব একটা অভ্যস্ত নই।
তবে অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন, এসবের কোনো কিছুই আজ ওদের এই যোজন সমান দুরত্বের কারণ নয়, কোনোদিন ছিলও না। এমনকি, অনীশ যেদিন প্রথম পেখমকে বিদিশার প্রতি ওর মুখচোরা আকাঙ্ক্ষার কথা জানাল, তখনও পেখম বেজায় খুশিই হয়েছিল। দূরদৃষ্টিতেও আশু ভবিষ্যতের এই সম্ভাব্য দুঃসম্ভাবনার কথা ওর মাথায় আসেনি।
খেয়াল করে দেখবেন, মরুদ্যানে ঘুরতে ঘুরতে কখনও চোরাবালির খপ্পরে পড়ে গেলে প্রথমে ভেজা মাটির নরম স্নিগ্ধতা আপনার ভয়াবহ ভবিতব্যের কথা আপনাকে জানতেও দেয় না। টের যখন পাবেন, ততক্ষণে খানিক আগের তুলতুলে মাটিই আপনার পদযুগলকে বটগাছের শিকড়ের মত আঁকড়ে ধরেছে, যে টান উপেক্ষা করে বেরিয়ে আসা একপ্রকার অসম্ভবই বটে।
ঠিক এটাই হয়েছিল অনীশের ক্ষেত্রে। প্রত্যুত্তরের ব্যবধান বাড়তে বাড়তে কখন যে পেখমের নামটা চ্যাটবক্সের অতলে তলিয়ে গেছে তা অনীশ ধরতেই পারেনি। যখন শেষমেষ টের পেল, ততক্ষণে বন্ধু ও প্রেমিকা দুজনকেই হারিয়ে এই বিশ্বসংসারে অনীশ ঘোরতর একা।
বিদিশাকে কতটা ফেরাতে চেয়েছিল অনীশ তা আমি জানি না। তবে পেখমকে চেয়েছিল, প্রবল ভাবে চেয়েছিল। কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। বহুদিনের উপেক্ষার পাহাড়ে যে অভিমানের পাঁচিল পেখম ততদিনে গড়ে তুলেছে, তা টপকে এগিয়ে যাওয়াটা অনীশের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। গতবার আম্ফানের পর বহুদিন বাদে অনীশই একবার সাহস করে পেখমকে মেসেজটা করেছিল। তারপর থেকে ওদের আবার কথা শুরু হয়েছে। যদিও তা নিতান্তই সাধারণ, আগেকার সেই উচ্ছলতার রেশ মাত্র নেই। এবং অনীশ জানে, তা আর কোনোদিন ফিরবেও না।
****
"হ্যালো, শুনতে পাচ্ছিস?"
স্মৃতির খেয়ায় ভাসতে ভাসতে নিজের অজান্তেই বর্তমান পৃথিবীর দিগন্তরেখা পেরিয়ে বহুদূর চলে যাওয়া অনীশের হুঁশ ফিরল পেখমের ডাকে,
"হ্যাঁ হ্যাঁ বল বল, নেটওয়ার্ক প্রব্লেম করছিল।"
"আচ্ছা। না সেরকম কিছুই না, জাস্ট জিজ্ঞেস করছিলাম যে হোয়াটসঅ্যাপ-এ কী পাঠিয়েছিলি?"
একটু থমকে গেল অনীশ। এই প্রশ্নটা যে আসবে সেটা ওর বোঝা উচিত ছিল। কী যে হয়েছিল ওর সেদিন রাতে! যতসব পাগলামো...নাহ্ ওসব আর ভেবে লাভ নেই, আপাতত কথাটা ওকে বলতেই হবে। দু-তিনটে ঢোঁক গিলে বারদুয়েক আমতা-আমতা করে তারপর অনীশ বলল,
"আসলে সেদিন রাতে হঠাৎ করেই অনেক পুরনো কথা মনে পড়ছিল। তাই খানিকটা আবেগ ও খানিকটা কৌতূহলের বশেই তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম।"
"কী কথা?"
"আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তুই এতদিন একটাও প্রেম করলি না কেন।"
খানিকক্ষণ সব চুপচাপ, ওপার থেকে কোনো উত্তর এল না। নিজেকে ধিক্কার দিল অনীশ, অনধিকার চর্চাটা করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কথা ঘোরাতে যাবে, এমন সময়ই পেখম বলে উঠল,
"তোর কী মনে হয়, কেন করিনি?"
"প্রশ্নের বদলে প্রশ্ন?", হেসে উঠল অনীশ।
"বল তো, মানুষ প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন কখন করে?"
"কখন?"
"যখন সেই প্রশ্নটার কোনো নির্দিষ্ট উত্তর হয় না।"
অনীশ বুঝল পেখম এটা নিয়ে কোনো কথা বলতে চায় না। তাই আর কথা বাড়াল না। বলল,
"হ্যাঁ তা ঠিক। যাকগে, সাবধানে থাকিস, সময়টা বড্ড কঠিন।"
"হ্যাঁ রে, তুই ও"
"শুভরাত্রি"
"শুভরাত্রি"
ফোনটা রেখে নিঃশব্দে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল পেখম। চোখের কোণে এক ফোঁটা জলের আভাস দেখে নিজেই হেসে ফেলল। বিড়বিড় করে বলল,
"ছেলেমানুষটা এখনও বুঝল না"।
****
Romantic Story
Comments