top of page

সত্যি হলেও গল্প | Fictiously True - A Bengali Short Story on Love, Loss and Destiny

  • Writer: Sagnik Ganguly
    Sagnik Ganguly
  • Sep 16
  • 5 min read
A cinematic split-image poster. The left side shows a woman reaching desperately towards a man in the middle of a city street at dusk, with a truck's headlights approaching in the background. The right side depicts a psychologist, Dr. Aparajita Chatterjee, speaking passionately at a podium to a large, attentive audience, with a smiling man's ghostly image in the background. The English subtitle 'A Tale of Love, Loss, & Reality's Game' is in the top right, and 'BASED ON STORY BY BHAVISHYA BHATTACHARYA' is in the bottom left.
In a world where love, loss, and the lines of reality intertwine, every moment counts. A story that blurs the boundaries of what's real and what's merely a narrative. Based on the compelling story by Bhavishya Bhattacharya.

"সরি। একটু দেরি হয়ে গেল", পেছন থেকে খুব চেনা গলাটা কানে আসতেই ঘুরে তাকাল অমিত। ওর কোঁচকানো ভুরু আর গম্ভীর মুখটা দেখে অপরাজিতা বুঝল যে আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। এক হাতে পার্স আর মোবাইলটা কোনোরকমে ধরে আর একটা হাত কানে দিয়ে বলল,

"ঠিক আছে, একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। মানছি বাবা। সরি। দেখো, কান মুলছি। এবার তো হাসো..."

হেসেই ফেলত অমিত। কিন্তু মনে মনে ভাবল, এই সুযোগ। বেশিরভাগ সময়েই রাগ দেখানোর কোনো সুযোগ পাওয়া যায় না। আজ যখন পেয়েছে, কাজে লাগাতে হবে। গাম্ভীর্যটা জোর করে ধরে রেখে থমথমে গলায় বলল,

"আড়াই ঘন্টা! আর ইউ কিডিং মি? আধ-এক ঘন্টা মানা যায়। আড়াই ঘন্টা কোনো মানুষ লেট্ করতে পারে? আজ যদি এটা এয়ারপোর্ট হত? কিংবা যদি সিনেমা? ফ্লাইট ও মিস হত, সিনেমাটাও শেষ হয়ে যেত। তার চেয়েও বড় কথা, এটা যদি আমি করতাম? তুমি দাঁড়াতে আদৌ? মনে আছে, একবার কুড়ি মিনিট দেরি করেছিলাম বলে চল্লিশ মিনিট কথা শুনিয়েছিলে। তাও আমার দোষ ছিল না। রাস্তায় তৃণমূল দূর্নীতির বিরুদ্ধে মিছিল বার করেছিল, তাই আটকে পড়েছিলাম। কিন্তু তার চক্করে আমার মা-মাটি-মানুষের তো গুষ্টি উদ্ধার করে দিয়েছিলে। কই, আমি তো কিছু বলিনি। কারণ আমি বলব কিভাবে? আমি মুখ খুললেই তো জোকার হয়ে যাই। আর তখন আমায় নিয়ে তুমি সার্কাস খেলো যেখানে দিনশেষে সব দোষ আমার ঘাড়ে এসেই পড়ে। সেদিনও চুপচাপ শুনেছি, আজও তাই করব ভেবেছিলাম। কিন্তু আড়াই ঘন্টা লেট্! কি ভাবো টা কি? তুমি আসবে, আর আমি তোমাকে মালা নিয়ে বরণ করব? চব্বিশ বছর বয়স। কথায় বলে মেয়েদের ম্যাচিউরিটি নাকি ছেলেদের চেয়ে বেশি। আমি জানতে চাই কোন হারামজাদা এই কথাটা বলেছিল। খুঁজে পেলে...", একটানা এতগুলো কথা বলে শেষমেষ থামল অমিত। খুব তাড়াতাড়ি এতকিছু বলতে বলতে খেয়ালই করেনি কখন ওর অপা-র দু-চোখের কোণে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। অমিতের কথা শেষ হতেই সেই ঘন কালো মেঘ বাঁধভাঙা বৃষ্টির মত ঝড়ে পড়ল,

"ঠিক আছে আমি খারাপ। আমার সব ভুল, তোমার সব ঠিক। আমি ইম্যাচিওরড্, ইরেসপন্সিবল্, অপদার্থ। খুশি? চলে যাচ্ছি আমি, তুমিও সাবধানে যেও", বলেই গটগট্ করে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল অপরাজিতা। অমিত বুঝল আজ একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। একসাথে এতকিছু বলাটা ঠিক হয়নি। আসলে হয়ত যুক্তির দিক দিয়ে ও ভুল কিছু বলেনি। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের আবেগের কাছে যুক্তি কবেই বা জয়লাভ করেছে? অতএব দৌড়ে গিয়ে অপরাজিতার হাতটা ধরে রাগ ভাঙানোর পালা শুরু করল অমিত,

"আরে তুমি চলে যাচ্ছো কেন? সরি। আমি ইচ্ছে করে বলিনি। তোমায় একটু রাগাচ্ছিলাম...আরে একি, ট্যাক্সি ডাকছ কেন?"

"আমি চলে যাচ্ছি, তোমার সাথে থাকা সম্ভব নয়"

"যাহ্ বাবা, সামনে ভোট নাকি যে পদত্যাগ করবে? তোমার পদত্যাগপত্র আমি বর্জন, ইয়ে মানে রিজেক্ট এর বাংলাটা ঠিক...যাই হোক, গ্রহণ করলাম না।"

"তুমি ইয়ার্কি মারছ? নাকি তোমার মনে হয় যে আমি ইয়ার্কি মারছি? তোমার কোনো ধারণা আছে তুমি আমায় ঠিক কি কি বলে অপমান করেছ?" 

"অপমান? তুমি রাজ্যপাল নাকি যে অপমানিত বোধ করছ?"

"ফাক্ ইউ...ট্যাক্সি...", অপরাজিতা অমিতের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। অমিত হাতটা বাড়িয়ে ওকে ধরতে গেল। পারল না। অপরাজিতা ততক্ষণে রাস্তার প্রায় মাঝখানে। অমিত দ্রুত পায়ে ফুটপাত ছেড়ে রাস্তার দিকে পা বাড়াল। আর তখনই...


****


ঘরভর্তি লোক স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। ঠোঁটের কোণের হাসির রেখা গুলো এখনও দিনের আলোর মত স্পষ্ট। ডঃ অপরাজিতা চ্যাটার্জী পোডিয়ামে রাখা টিস্যু বক্সটা থেকে একটা টিস্যু বার করে চোখটা মুছে বললেন,

"সো মাই ডিয়ার ফ্রেন্ডস্, ডু নট্ ওয়েস্ট টাইম। সেদিন যদি অমিতের মজার ছলে বলা কথাগুলো মজার ছলেই নিতাম, তাহলে হয়ত সেই দ্রুতগতিতে ছুটে আসা লড়িটা আমার ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নিত না। আসলে আমি জানতাম না আমাদের হাতে সময় এতটা কম ছিল। জানলে হয়ত...", একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ডঃ চ্যাটার্জীর ভেতর থেকে বেরিয়ে ঘরের আনাচে-কানাচে মিলিয়ে গেল। খানিকক্ষণ থেমে নিজের জীবনের সবচাইতে দুর্বল অংশটা ঢেকে নিয়ে তিনি বললেন, "আমাদের প্রত্যেকের কাছেই সময় বড় অল্প। জীবনের এলার্মক্লক এগিয়ে চলেছে পরিণতির দিকে। কেউ জানি না কখন ঘন্টা বাজবে। শুধু এটুকু জানি, বাজবেই। আর যেই না সময় শেষ হবে, অমনি সমস্ত পিছুটান ফেলে চলে যেতে হবে নিয়তির পথে। সো ফোকস্, ইউজ এভরি বিট্ অফ ইউর টাইম কেয়ারফুলি। যা ভালো লাগে করো, কিন্তু করো। সময় নষ্ট কোরো না। নয়ত একদিন আমারই মত জীবনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আফশোস করে বলতে হবে, ঈশ্, সেদিন যদি...থ্যাঙ্ক ইউ, এন্ড অল্ দ্য বেস্ট্!"


সমগ্র ঘরটা করতালিতে ফেটে পড়ল। বিশ্ববিখ্যাত সাইকোলজিস্ট ডঃ অপরাজিতা চ্যাটার্জী ধীর পায়ে স্টেজ থেকে নেমে পড়লেন। 


সংবর্ধনা ও আরও কিছু টুকটাক কথাবার্তা সেরে অপরাজিতা যখন গাড়িতে উঠলেন, তখন ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে ন'টা। ফোনটা অন করেই একটা খুব চেনা নম্বর ডায়াল করলেন। বার তিনেক বাজার পর ওপার থেকে সেই পরিচিত স্বর ভেসে এল,

- গাড়িতে উঠলে?

- হ্যাঁ, জাস্ট। তুমি কখন ফিরলে?

- এই আধ ঘন্টা আগে। আর বোলো না, একটা মিটিংয়ের চক্করে দেরি হয়ে গেল। এবার মনে হচ্ছে পাতাটা ফেলতে হবে। যাকগে, হাউ ওয়াজ ইওর ডে?

- গুড। যেরম হয় আর কি।

- আজও আমায় মেরে ফেললে নিশ্চয়ই?

- ওহ্ ফর শিওর। এই স্টোরিটা পাবলিক্ খুব ভালো খায়।

- চমৎকার। কোথায় দুশো বছর আগের সতীদাহ প্রথা, আর কোথায় এখন স্বামীর মৃত্যুর গাঁজাখুরি গল্প বেচে বউয়ের নোট ছাপা। কি পরিবর্তন!

- বাজে বোকো না। তোমার পারমিশন্ নিয়েই যা করার করছি, একদম দোষ দেবে না। 

- আমি এক্সিডেন্ট অবধি রাজি হয়েছিলাম। পটল তুমি তুলিয়েছ।

- বেশ করেছি। এখন রাখলাম, মাথাটা ভীষণ ধরে আছে। তোমার খিদে পেলে খাবারটা গরম করে নিও। আমার এখনও ঘন্টা খানেক সময় লাগবে।

- ঠিক আছে। সাবধানে এসো।


ফোনটা ব্যাগে রেখে জানালায় মাথাটা এলিয়ে দিলেন অপরাজিতা। চোখটা বুজে আসছে ঘুমে। আর ঠিক তখনই একটা তীব্র ঝাঁকুনি...মুহূর্তেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে ছিটকে গেল তার নতুন কেনা এস-ইউ-ভি টা।


****


"গল্পটা কেমন লাগল স্যার?", হাতে ধরা ম্যানুস্ক্রিপ্টটা পড়া শেষ করে মুখটা তুলে জিজ্ঞেস করলেন ভবিষ্য ভট্টাচার্য। সামনে ভুরু কুঁচকে বসে আছেন বাংলা ইন্ডাস্ট্রির নামকরা প্রোডিউসার মিঃ অমিত ভেঙ্কটেশ। একটা লম্বা আড়মোড়া ভেঙে বেল্ টিপে রুম বয়কে এককাপ কফি করতে বলে ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললেন,

"চলবে না।"

"সেকি! কিন্তু কেন?", রীতিমত হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করলেন ভবিষ্যবাবু।

প্রশ্নটা শুনে মৃদু হাসলেন মিঃ অমিত। হাসির ফাঁকে ভদ্রলোকের দুটো সোনা বাঁধানো দাঁত ভবিষ্যবাবুর চোখে পড়ল। ভদ্রলোক বললেন,

"চলবে না কারণ এটা হলিউড নয়। চলবে না কারণ আপনি ক্রিস্টোফার নোলান কিংবা সৃজিত মুখার্জি, কেউই নন্। প্রথম ফিল্ম; হয় রিমেক করুন, নয়ত সিম্পল করুন। সাহিত্যনির্ভরও করতে পারেন। তবে নতুন গল্প। পুরোনোগুলো বাঙালিও আজকাল আর পাতে দিচ্ছে না। আপনার লেখার হাত আছে। এই স্ক্রিপ্টটা আপাতত সরিয়ে রাখুন। এ লাইনে নাম করতে পারলে বছরখানেক বাদে দেখা যাবে খন্। অন্য কিছু লিখুন। দিয়ে নেক্স্ট মান্থ-এ দেখা করুন", কথা শেষ হতেই ভদ্রলোকের ফোনটা বেজে উঠল। অতএব আর কিছু বলার নেই বুঝে ভবিষ্যবাবু উঠে পড়লেন। বেশ অনেকটাই যেতে হবে। রাতও হল অনেক। বাস পেলে হয়!

বাইরে বেরিয়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎই দেখলেন মিঃ অমিত দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন। ওঁর ড্রাইভার বাড়ি লাগোয়া গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করছে। ভদ্রলোকের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কৌতূহল চাপতে না পেরে দ্রুতগতিতে রাস্তাটা পেরিয়ে ভদ্রলোকের সামনে যেতেই ভদ্রলোক ওকে দেখে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন। কি হয়েছে কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলেন যে অমিতবাবুর স্ত্রী-র একটু আগেই এক্সিডেন্ট হয়েছে। হাওড়ার কোন কলেজে একটা সেমিনার সেরে ফিরছিলেন। হাইওয়েতে একটা লড়ি এসে ধাক্কা মেরেছে। আপাতত সেখানেই যাচ্ছেন। কথাটুকু বলেই গাড়িতে উঠলেন মিঃ অমিত। ভবিষ্যবাবু ওনার হাতটা ধরে বললেন,

"আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।"

মিঃ অমিত কান্নাভেজা গলায় বললেন,

"থ্যাঙ্কস। প্লিজ প্রে ফর অপরাজিতা।"


গাড়িটা স্টার্ট নিয়ে একরাশ ধুলো ছেড়ে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেল। আর পেছনে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী ও সম্ভাবনাময় লেখক ভবিষ্য ভট্টাচার্য। 


****


"কাট্", ডিরেক্টরের চিৎকারে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আজকের সবচাইতে লম্বা শট্ ছিল এটা। আপাতত আজকের মত প্যাক আপ। আবার কাল নতুন দিন, নতুন সিন্। 

জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে নবাগত এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর শিলাদিত্য চৌধুরী পরিচালক সৃজিত মুখার্জিকে জিজ্ঞেস করলেন,

"স্যার, স্ক্রিপ্টটা তো খাসা হয়েছে। কিন্তু সিনেমার নামটা আপনি বলছিলেন চেঞ্জ করবেন!"

"হ্যাঁ, করব", স্ক্রিপ্টের পাতাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে বললেন সৃজিতবাবু, "কারণ আমার মনে হয় যেটা ভেবেছি, তার চেয়ে বেটার নাম হয় না।"

"নামটা কি বলা যাবে?", জিজ্ঞেস করলেন শিলাদিত্য।

মৃদু হেসে একটা কাগজের টুকরা তুলে নিয়ে তাতে খসখস করে কি একটা লিখে শিলাদিত্যর দিকে বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রলোক। কাগজটা হাতে নিয়ে দেখতেই শিলাদিত্যর মুখেও হাসি ফুটে উঠল। সত্যিই, এর চেয়ে ভালো নাম আর হয় না। কাগজটা মুড়ে চেয়ারের ওপর রাখলেন শিলাদিত্য। আর তখনি টেবিল ফ্যানের দমকা হাওয়া কাগজটাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। শিলাদিত্য হাত বাড়ালেন, কিন্তু ধরতে পারলেন না। কাগজটা অবশ্য একটু দূরেই মেঝের ওপর পড়ে গেল। পায়ে পায়ে সেটার দিকে এগিয়ে গেলেন শিলাদিত্য। স্টুডিয়োর জমকালো আলোয় কালো কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা শব্দগুলো তখন জ্বলজ্বল করছে। শিলাদিত্য নীচু হয়ে কাগজটা তুলে পকেটে ভরলেন। আর পরক্ষণে নিজের মনেই খানিকটা বিড়বিড় করে বললেন,

"সত্যি। গল্প হলেও সত্যি।"


—-*----

Comments


bottom of page