ওয়েটিং রুম - Horror Stories
- Sagnik Ganguly
- Oct 31, 2024
- 8 min read

ট্যাক্সিটার ভাড়া মিটিয়ে তেজপুর জংশনে যখন ঢুকলাম, তখন প্রায় রাত দশটা বাজে। আমার ট্রেন ছিল এগারোটায়। কিন্তু ধন্যবাদ ভারতীয় রেল, ট্রেনটা প্রায় ছ-ঘন্টা দেরিতে চলছে। অতএব সকালের আগে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। একবার ভেবেছিলাম হোটেল নেব কিনা। কিন্তু মাত্র একটা রাতের ব্যাপার। তার উপর আমার এসি টু টায়ার-এর টিকিট। জংশন স্টেশনে প্রথম শ্রেণীর ওয়েটিং রুম থাকবেই। সেখানে পায়ের ওপর পা তুলে একটা রাত কাটানো বিশাল কিছু কঠিন হবে বলে মনে হয় না। এই ভেবেই স্টেশনে ঢুকেছিলাম। কিন্তু হায় ভগবান! গোটা স্টেশনে একটা মাত্র ভাঙাচোরা ওয়েটিং রুম। তাতে এসি দূরের ব্যাপার, ফ্যান টাও ঠিক ভাবে চলছে না। অরুণাচল প্রদেশে ঢোকার আগে তেজপুর-ই আসামের শেষ বড় জংশন। সেখানে এরকম অবস্থা আশা করিনি। বেশ হতাশ লাগছিল। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। ব্যাগটা রেখে একটা বেঞ্চির ওপরেই গুছিয়ে বসলাম। ঘরে আরও তিন-চারজন এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে ছিলেন। সবার নজরই নিজের ফোনের দিকে। স্টেশনে আসার পথে আমিও একটা ওয়েব সিরিজ দেখা শুরু করেছিলাম। ওটাই আবার ধরলাম। একমনে দেখতে দেখতে কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল নেই। হুঁশ ফিরল কাঁধে একটা আলতো টোকায়। তাকিয়ে দেখি একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক, গলায় উত্তর-পূর্ব রেলওয়ের আইডি কার্ড ঝুলছে। ভদ্রলোক বললেন,
- নমস্কার, আমি এখানকার স্টেশন মাস্টার। আপনার ট্রেন কখন?
আমিও প্রতিনমস্কার করে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। ভদ্রলোক খানিকটা চিন্তিত হয়ে বললেন,
- আপনি কি রাতটা এখানেই কাটাবেন ঠিক করেছেন?
- হ্যাঁ। কিন্তু তাতে কি কোনো অসুবিধা আছে?
- না অসুবিধা ঠিক না...ভদ্রলোক একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, আসলে রাতে মাঝে মাঝেই এই লাইনে কোনো ট্রেন চলে না। তখন গোটা স্টেশনটাই সম্পূর্ণ ফাঁকা থাকে। লাইট গুলোও বেশিরভাগই...তাই বলছিলাম যদি চোর-ডাকাত...যদিও আমি কোনোদিন চোর-ডাকাত নিয়ে তেমন কিছু শুনিনি। তবে সেটা ছাড়াও...ভদ্রলোক এই অবধি বলেই চুপ করে গেলেন।
আমি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম সেটা ছাড়াও আর কি হতে পারে, ভদ্রলোক আমায় কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বলে উঠলেন,
- তবে হ্যাঁ, মনে হয়না চিন্তার কোনো কারণ আছে। শুধু রাতে এই ঘরের দরজাটা বন্ধই রাখবেন। মানে ভেতর থেকে খিল দিয়ে। চোর-ডাকাতের জন্য না, শেয়াল-কুকুরের জন্যও। চারপাশের জঙ্গুলে পরিবেশে সেসবের অভাব নেই।
আমি কি বলব কিছু বুঝে না পেয়ে হতভম্বের মত ঘাড় নামলাম। ভদ্রলোক নিজের চিন্তার ভাবটা কোনোরকমে লুকিয়ে পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু বেরোনোর ঠিক আগেই হঠাৎ কি যেন একটা মনে করে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে খানিক আমতা আমতা করে বললেন,
- আর একটা কথা ছিল।
- হ্যাঁ বলুন।
- রাতে যদি আপনাকে ঘরের বাইরে থেকে কেউ ডাকে, তবে ভুল করেও দরজাটা খুলবেন না। তা সে যতই ছটফট্ করুক।
এটা বলেই ভদ্রলোক আমার কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে হুড়মুড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে তারপর আবার ঘরটার চারপাশে একবার তাকালাম। এতক্ষণ খেয়াল করিনি যে একটু আগেও ঘরে যে গুটিকয়েক লোক ছিল, তাদের একজনও আর এখন এখানে নেই। আরও খানিকটা অবাক হয়ে হাতের ঘড়িটার দিকে চাইতে দেখি বারোটা বেজে পাঁচ। সিরিজটা দেখতে দেখতে যে প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে গেছে সেটা বুঝতেই পারিনি। অতঃপর করার মত কিছু নেই দেখে আবারও অর্ধসমাপ্ত এপিসোডেই ফিরে গেলাম। কিন্তু ছেদ্ পড়ল ঠিক মিনিট পাঁচেক বাদেই। সেই স্টেশন মাস্টার, আবারও। কাঁধের ব্যাগটা দেখে বুঝলাম ভদ্রলোক বেরোচ্ছেন। প্রায় কাকুতির স্বরেই আমায় দরজাটা বন্ধ করতে বললেন। ভদ্রলোককে দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে উনি আমার থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছেন। কিন্তু আর কিছু বললাম না। উঠে দরজাটা বন্ধ করে আবারও সিরিজে মন দিলাম।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর দুটো এপিসোড শেষ করে কান থেকে হেডফোনটা খুললাম। এতক্ষণ একটানা বসে থেকে কোমরটা ধরে গেছে। ক্ষিদেটাও বেশ পেয়েছে। আর কিছু না হোক, অন্তত এক কাপ চা পেলেও চলে। আশেপাশে কোনো চায়ের দোকান আছে কিনা দেখলে হয়; ভাবতে ভাবতেই বেঞ্চিটা থেকে উঠে পড়লাম। পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে দরজাটা খুলতে গিয়েই দুটো জিনিস লক্ষ্য করলাম। এক, দরজার খিলটা ভীষণই নড়বড়ে; মানে এটা দেওয়া আর না দেওয়া দুই-ই সমান। আর দুই, বাইরে জনমানসের সাড়াশব্দটুকুও নেই। একটা অদ্ভুত নিশ্ছিদ্র নীরবতা যেন চারপাশকে গ্রাস করে রেখেছে। পরক্ষণেই স্টেশন মাস্টারের সাবধানবাণীটা মনে পড়ল। দরজাটা খোলা আদৌ ঠিক হবে কিনা ভাবতে ভাবতে খানিকটা আপন মনেই দরজাটা খুলে ফেললাম। আর তৎক্ষণাৎ বাইরের ভীষণ গাঢ় অন্ধকারটা ঘরের এই সামান্য আলোটুকু মিইয়ে দিল। অবাক হয়ে দেখলাম কুয়াশামোড়া গোটা স্টেশনে একটা টুনি লাইটও জ্বলছে না। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই প্ল্যাটফর্মের ধারটায় এসে দাঁড়ালাম। দুদিকেই অনেকটা দূরে সিগন্যালের লাল আলোর হালকা ছটা চোখে পড়ল। যাক, একটু আলোর স্পর্শ টুকু তো মিলল! এমনিতে সময়টা ডিসেম্বরের শুরু; পাহাড়ি জায়গা হলেও ঠান্ডাটা এখনও বিশাল কিছু জাঁকিয়ে পড়েনি। তাই আপাতত শার্টের ওপর একটা পাতলা হুডিতেই বেশ চলে যাচ্ছে।
স্টেশনের ওপর হাতে গোনা কয়েকটা দোকান; আর এত রাতে খুব স্বাভাবিক ভাবে সবগুলোই বন্ধ। আরও অদ্ভুত ব্যাপার গোটা স্টেশনে একটা নেড়ি কুকুরও চোখে পড়ছে না। এরম জনমানবশূন্য স্টেশন আমি এ জীবনে তো দেখিইনি, এমনকি কোনোদিন শুনেছি বলেও মনে পড়ে না।
আরও মিনিট খানেক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আবার সেই ওয়েটিং রুমেই ফিরে গেলাম। ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপারে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলাম। পরিষ্কার মনে আছে যে ব্যাগগুলো আমি বেঞ্চের ওপরে তুলে শুইয়ে রেখেছিলাম। এখন সেগুলো মাটিতে একরাশ পুরু ধুলোর মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পড়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই কারণ এরম নিশ্ছিদ্র নীরবতায় এরকম ভারী ব্যাগ নীচে পড়লে তার শব্দ আমি ঠিকই পেতাম। তবে কি আমি আদৌ তুলে রাখিনি? খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েই পায়ে পায়ে ব্যাগগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে ধুলো ঝেড়ে আবার তুলে রাখলাম।
হয়ত মনের ভুল; এই ভেবেই মনকে প্রবোধ দিলাম। করার তো কিছুই নেই। অগত্যা আবারও হেডফোনটা লাগিয়ে সিরিজের পরের এপিসোডটা চালিয়ে নিলাম। কতক্ষণ দেখেছি জানি না, বোধহয় মিনিট পাঁচেক হবে। দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দে চমকে উঠে কান থেকে হেডফোনটা খুলে ফেললাম। কোথাও কিছু নেই, চারদিকে একই রকম শুনশান নিস্তব্ধতা। বিষয়টা এতটাই অদ্ভুত যে রীতিমত নিজেরই নিজের ওপর সন্দেহ হল যে আদৌ ঠিক শুনেছি কিনা। একবার মনে হচ্ছে যে না, ঠিক শুনেছি, দু-বার ঠক্ ঠক্। আবার পরক্ষণেই লাগছে যে না, ব্যাপারটা প্রবলই মনের ভুল। হয়ত একটু আগের ব্যাগের বিষয়টা থেকেই এসব মাথায় আসছে।
নাহ্, তেমন কিছু নয়, এই ভেবে বিষয়টা মন থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আবার হেডফোনটা হাতে নিলাম। আর ঠিক তখনই...নাহ্ এবার আর মনের ভুল নয়, রীতিমত দিনের আলোর মত স্পষ্ট...ঠক্ ঠক্। ঠিক দু'বার। মনে হল যেন শিরদাঁড়া বেয়ে একটা বরফ ঠাণ্ডা স্রোত নীচে নেমে গেল। কি করব কিছু বুঝতে না পেরে খানিকক্ষণ রোবটের মত বসে রইলাম। আর ঠিক তারপরই, আবারও, ঠক্ ঠক্। এবার রীতিমত জোরে। কাঁপা কাঁপা পায়ে কোনোরকমে উঠে দাঁড়ালাম। বেঞ্চি থেকে দরজা অবধি দূরত্বটা যেন মাইল খানেক ঠেকছে। এক পা এক পা করে যতক্ষণে দরজা অবধি পৌঁছলাম ততক্ষণে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মনের ভেতর যতটা সম্ভব জোর এনে এক ঝটকায় দরজাটা হাট করে খুলে ফেললাম, আর দেখলাম...নাহ্, কেউ নেই। সেই একই রকম অন্ধকার, সেই একই রকম নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ।
ঘর থেকে বেরিয়ে প্ল্যাটফর্মের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দূরের লাল আলোটা এখন আরও আবছা লাগছে। মনে হল এই ভীষণ অন্ধকার যেন আমায় ব্যঙ্গ করছে। কি ভীষণই না ভীতু আমি, সত্যি! সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল নেই। হঠাৎই, কী একটা যেন একটা পেছন থেকে দ্রুত গতিতে সরে গেল। চমকে পেছন ঘুরে দেখলাম। নাহ্, কিচ্ছু নেই। আমার কি তবে সত্যিই হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? নিজের এই অবস্থা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বাকি রাতটা ঘরের ভেতরে ঢুকেই কাটিয়ে দেব স্থির করলাম। সেই মত ঘরের দিকে পা বাড়াতেই থমকে গেলাম। খোলা দরজার ভেতরে আমার এতক্ষণের বাসস্থান কাঠের ভাঙাচোরা বেঞ্চিটা চোখে পড়ছে। আর তার ঠিক সামনেই মেঝের ওপর একটু আগেই সযত্নে তুলে রাখা আমার লাগেজ দুটো লুটিয়ে পড়ে আছে। একটু আগের সাহসটা হঠাৎই যেন কর্পূরের মত উবে গেল। মনে হল, ঘরটার দিকে আর এক পা-ও এগোনোর মত সাহস আমার নেই। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই কাঁধের ওপর একটা আলতো স্পর্শে আমি শিউরে উঠে পেছনে ঘুরলাম, আর দেখলাম, একজন থুরথুরে বুড়ো। মাথা সমেত গোটা মুখটাই সাদা চুলে ঢাকা। পড়নে শতচ্ছিন্ন ফতুয়া, আর হাতে একটা লাঠি। দেখে মনে হচ্ছে বয়সের কোঠা বহু যুগ আগেই আটের দশক পেরিয়েছে। সামান্য ভয়, খানিকটা লজ্জা, অনেকটা বিষ্ময়, আর একরাশ বিরক্তি মেশানো গলায় হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলাম,
- কে আপনি? এত রাতে এখানে কি করছেন?
লোকটা তখনই কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ আমার মাথা থেকে পা অবধি পরখ করে ভীষণ চাপা খ্যাসখ্যাসে স্বরে বলল,
- আমি এখানেই থাকি। কিন্তু তুমি কে?
আমার ট্রেন রাতে ছিল। লেট্ হয়ে এখন সকালের আগে আসবে না। তাই ওয়েটিং রুমেই রাতটা কাটাব ভেবেছিলাম ।
- হ্যাঁ তো কাটাও না। বাইরে দাঁড়িয়ে কি করছ?
- ওখানেই ছিলাম। হঠাৎই কে একটা দরজায় টোকা দিচ্ছিল বারবার করে। তাই দেখতে এলাম।
- কিছু পেলে?, লোকটা কিরম সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল।
আমি একটু আমতা আমতা করে ভীষণ লজ্জিত ভাবে বললাম,
- না মানে সেরকম কাউকে তো...
- তাহলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কি করছ? ভেতরে চলো।
- হ্যাঁ চলুন...আমার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই উনি দেখলাম চলতে শুরু করে দিলেন। হাতে লাঠি থাকা সত্ত্বেও সেটার ব্যবহার না করে খুব অদ্ভুত ভাবে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। একবার ভাবলাম বলি। কিন্তু থাক, কোনো প্রয়োজন নেই ভেবে চুপচাপ ওনার পেছন পেছন ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করার জন্য পিছু ঘুরতেই ঘরের আলোটা ঝুপ করে নিভে গেল। একটু আগের সেই ঠান্ডা স্রোতটা আবারও শিরদাঁড়ার আনাচে-কানাচে জানান দিল। কোনো রকমে পকেটে হাত দিয়ে ফোনটা বার করে ফোনের আলোটা জ্বালাতে গেলাম। কিন্তু আরও সাংঘাতিক ব্যাপার, ফোনটা অন অবধি হল না। অথচ খানিক আগে পর্যন্ত মনে আছে ষাট্ শতাংশের বেশি চার্জ ছিল। এতক্ষণে আমি বুঝতে পেরে গেছি স্টেশন মাস্টার আমার থেকে ঠিক কি লুকোচ্ছিল। কি করব কিছু বুঝতে না পেরে দরজা দিয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই গা-টা শিরশির করে উঠল; আমার অজান্তেই দরজাটা কখন যেন বন্ধ হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম আমার বুকের কাছটা ক্রমশই ভারী হয়ে উঠছে। ঠিক তখনই সামনে থেকে সেই ভীষণ রকম গলাটা বলে উঠল,
- দরজার কাছে কেন, এখানে এসে বোসো।
মনে হল শেষের কথাটায় যেন খানিকটা ব্যঙ্গ লুকিয়ে আছে। নিজের সমস্ত প্রতিরোধ উপেক্ষা করে আমি যেন একটা চুম্বকে আকর্ষণে আটকে থাকা লোহার আঙটার মত সামনের দিকে এক পা এঅ পা করে এগিয়ে চললাম। কিন্তু ঠিক সামান্য কিছু ষটা গিয়েই একটা বেশ ভারী কিছুতে হোঁচট খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। লোকটা ওর একটা হাত বাড়িয়ে আমায় না ধরলে সটান মেঝেতেই পড়তাম। কিন্তু লোকটার হাতটা কি ভীষণ রকম ঠান্ডা। কোনোরকমে সোজা হয়েই ছিটকে সরে গেলাম। আর পরক্ষণেই মনে একটা প্রশ্ন জেগে উঠল,
হোঁচটটা খেলাম কিসে? আমার ব্যাগ গুলোয় কি? কিন্তু ব্যাগ তো এত কাছে থাকার কথা নয়। আমার বসার বেঞ্চের একদম শেষ প্রান্তে রাখা ছিল। ঘরের মধ্যে আর কিছু ছিল বলেও মনে পড়ে না। তবে...
- হোঁচটা নিতান্তই কাকতালীয়। কিন্তু জিনিসটা নয়।
কথাগুলো ঠিক যেন আমার ঘাড়ের পাশ থেকে ভেসে এল। চমকে পিছনে ফিরলাম। আর দেখলাম একটা বিভৎস দৃশ্য । যে জিনিসটায় আমি হোঁচট খেলাম, সেটা একটা বেশ বড় রকমের বস্তা। আর সেই বস্তার খোলা মুখ থেকে বেরিয়ে রয়েছে একটা রক্তাক্ত কাটা মুন্ডু যার চোখদুটো ঠিক ভাটার মত জ্বলছে। এই মুখটা আমার ভীষণই চেনা। আরও বিশেষ ভাবে বললে, বিগত দশমিনিট ধরে এই মুখটাই আমি দেখে আসছি।
এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। ওয়েটিং রুমের সেই ঘরের পরদিন ভোরে আমার সংজ্ঞাহীন শরীরটা লোকজন উদ্ধার করে। সেখান থেকেই সরাসরি হসপিটাল, এবং তারপর চারদিন সেখানেই। প্রথমদিকে প্রবল জ্বরে আমি প্রায় সারাক্ষণই ভুল বকে গেছি। ফলত খুব উচ্চ মাত্রার ওষুধের প্রয়োগে শরীরটাও ভীষণ কাহিল হয়ে পড়ে। তার ওপর মনের অবস্থা ছিল তথৈবচ। কিন্তু আর বেশিদিন দেরি করা যেত না। তাই দিন-চারেক পর বেলার ট্রেনে আমার বুকিং হয়ে যায়।
সেদিন সকালে হসপিটাল থেকে রিলিজ নিয়ে স্টেশনে আসি। স্টেশন মাস্টার আমার লাগেজ গুলো সাবধানে রেখে দিয়েছিলেন। আমাকে দেখেই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে বসতে দিলেন। বেয়ারাকে বলে চা-ও আনালেন। তারপর একবার গলা খাঁকারি দিয়ে হাত জোড় করে খানিকটা লজ্জিত ভাবেই বললেন,
- আমায় ক্ষমা করবেন। আমার জন্যই আপনার এই অবস্থা। আগেভাগে সবটা খুলে বললে হয়ত এই ঘটনা ঘটত না।
আমি ওনার হাত দুটো ধরে বললাম,
- না না আপনার দোষ নেই। আপনি বললেও হয়ত আমি সেসব বিশ্বাস না করে স্টেশনেই রাত কাটাতাম। তবে, ব্যাপারটা আসলে কি?
ভদ্রলোক চারপাশে একবার চেয়ে নিলেন। তারপর চেয়ারটা সামনের দিকে টেনে মৃদু গলায় বলতে শুরু করলেন,
- আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে এক রাতে এখানে এক বুড়ো এসে আশ্রয় নিয়েছিল। ওর কাছে অজস্র গয়না-গাটি, সোনা-দানা ও আরও দামী জিনিসপত্র ছিল। কোথা থেকে তা পেয়েছিল কেউ জানে না। সেও রাতটা স্টেশনের ওয়েটিং রুমেই কাটাবে স্থির করেছিল। কিন্তু পরদিন সকালে তার বস্তাবন্দি লাশ ঐ ওয়েটিং রুমে পাওয়া যায়। আর সঙ্গের ব্যাগ সব উধাও। পুলিশ বছর খানেক চেষ্টা করেথিল খোঁজার। কিন্তু কাউকে ধরতে না পেরে শেষমেষ কেস্ ক্লোজ্ করে দেয়। তার পর থেকেই...
ভদ্রলোকের কথা শেষ হতেই মাইকে আমার ট্রেনের আগমনের এনাউন্সমেন্টটা শুনতে পেলাম। আমি আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোককে একটা নমস্কার করে বিদায় জানিয়ে ব্আমার লাগেজ দুটো নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে এসে একটা কুলিকে জিজ্ঞেস করলাম,
- ভাইসাহাব, বি-ওয়ান কামরা কাঁহা আয়েগা?
কুলিটা মুখ থেকে জরদা দেওয়া পানের পিক্ থু করে পাশে ফেলে বলল,
- ইঁহা সে থোরা সিধা যাতে হি লেফ্ট মে এক ওয়েটিং রুম আয়েগা। উসকে সামনে।
কুলিটার শেষ কয়েকটা শব্দ আমার কানে ঢুকল না। এই প্রবল দিনের আলোতেও আমার শরীরটা ভীষণ ভয়ে ঘামতে শুরু করেছে। আমার চোখের সামনে বেলা বারোটার রৌদ্রজ্জ্বল দিন মুছে এখন ভেসে উঠেছে সেদিনের সেই বিভীষিকাময় রাত্রি, আর সেই রাতের ভীষণ আতঙ্কের সেই ওয়েটিং রুম।
- সমাপ্ত-
Horror Stories
Comments